১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির স্বাধীনতার জন্য লড়াই এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মম দমননীতির বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক প্রতিরোধ। বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) মানুষ দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছিল। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বৈষম্য ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে বাঙালিদের নিরঙ্কুশ বিজয় এবং পরবর্তী সময়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের টালবাহানার মধ্য দিয়ে সেটি চরম রূপ নেয়। এই পটভূমিতে ২৫শে মার্চ, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী “অপারেশন সার্চলাইট” নামে একটি নৃশংস গণহত্যা অভিযান শুরু করে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা করে।
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে দুটি অংশ নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়। জনসংখ্যার অধিকাংশ পূর্ব পাকিস্তানে হলেও পশ্চিম পাকিস্তান ছিল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। পূর্ব পাকিস্তান বরাবরই বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হয়।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। বাঙালিরা এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়, যা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে এক অনন্য সংগ্রামের রূপ নেয়।
অর্থনৈতিক বিষয়েও পূর্ব পাকিস্তান ছিল চরমভাবে বঞ্চিত ও অবহেলিত। দেশের বৈদেশিক আয়ের সিংহভাগ আসত পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন পণ্যের রপ্তানি আয় থেকে, অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হতো রপ্তানি আয়ের বেশিরভাগ অংশ।
১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং এর প্রভাব
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসন পায়, যা সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট ছিল।
কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃত্ব, বিশেষত প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো, ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা দিতে থাকেন ও যড়যন্ত্র শুরু করেন। এই অচলাবস্থা এবং রাজনৈতিক সংকট পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে স্বাধীনতার দিকে ধাবিত করে।
অপারেশন সার্চলাইট: পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার সূচনা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকায় “অপারেশন সার্চলাইট” নামে এক নৃশংস সামরিক অভিযান শুরু করে। ঢাকার রাস্তাঘাট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স সহ বিভিন্ন জায়গায় নির্বিচারে গুলি চালিয়ে এক রাতের মধ্যেই হাজার হাজার মানুষ হত্যা করা হয়।
গণহত্যার লক্ষণীয় দিক
পাকিস্তান সেনাবাহিনী মূলত বাঙালি বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, ছাত্র, এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে টার্গেট করে। নারী নির্যাতন ছিল অবর্ণনীয়। অসংখ্য নারী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হন। গ্রামে গ্রামে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া এবং সম্পদ লুটপাট করার মতো অন্যায় ও মানবতা বিরোধী কার্যক্রম চালানো হয়।
স্বাধীনতা সংগ্রাম: একটি রক্তক্ষয়ী অধ্যায়
মুক্তিবাহিনী গঠন: মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালায়।
প্রশিক্ষণ শিবির: ভারতে শরণার্থী শিবিরে মুক্তিযোদ্ধারা সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।
গেরিলা কৌশল: ব্রিজ ধ্বংস, টেলিযোগাযোগ লাইন বিচ্ছিন্ন করা, এবং ছোট ছোট অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীকে বিপর্যস্ত করে তোলা হয়।
আন্তর্জাতিক সহায়তা: ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) কূটনৈতিক সমর্থন এবং সামরিক সহযোগিতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বড় ভূমিকা রাখে।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ: ১৯৭১ এর ডিসেম্বরে ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিলে যৌথ আক্রমণ চালায়। এতে পাকিস্তানি বাহিনী পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়।
স্বাধীনতা সংগ্রাম: একটি জাতির অভ্যুত্থান
২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হামলার পর শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন (এটা নিয়ে বাংলাদেশে মতবিরোধ আছে)। এই ঘোষণা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের মাধ্যমে বাস্তব রূপ পায়। দেশজুড়ে মুক্তিযোদ্ধারা সশস্ত্র প্রতিরোধ কার্যক্রম গড়ে তোলে।
মুক্তিযুদ্ধ মূলত নয়টি সেক্টরে বিভক্ত ছিল এবং প্রতিটি সেক্টর পরিচালনা করতেন সেক্টর কমান্ডাররা, এর পাশাপাশি নৌ-সেক্টর (১০ নং সেক্টর) নামে একটি বিশেষায়িত সেক্টর ছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন পাকিস্তান নৌবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তা ও নৌ সেনারা। এছাড়া মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক পরিচালনা করেছিল। মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছিলেন।
উল্লেখযোগ্য দলিল
প্রখ্যাত সাংবাদিক আর্চার কে ব্লাডের লেখা The Blood Telegram: India’s Secret War in East Pakistan এবং সাঈদ হক ও রবার্ট পেইনের The Cruel Birth of Bangladesh বইয়ে গণহত্যার ভয়াবহ বিবরণ পাওয়া যায়।
গণহত্যায় আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও স্বীকৃতি
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই গণহত্যা সারা বিশ্বে আলোচিত ও নিন্দিত হয়। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের সংঘটিত গণহত্যা ছিল বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম নৃশংস ঘটনা। তবে আন্তর্জাতিক মহলে এটি এখনও যথাযথ স্বীকৃতি পায়নি।
২০১৭ সালে কানাডার পার্লামেন্ট এই গণহত্যাকে “জেনোসাইড” হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
অমর্ত্য সেন: এই গণহত্যাকে ‘ধ্বংসাত্মক জাতিগত নিধন’ বলে আখ্যায়িত করেন।
আন্তর্জাতিক মিডিয়া: Time এবং The New York Times গণহত্যার চিত্র বিশ্বব্যাপী তুলে ধরে।
সাইমন ড্রিং: বাংলাদেশের পরম বন্ধু হিসেবে বিবেচিত প্রয়াত ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় কর্মরত থাকার সুবাদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ও পালিয়ে বাংলাদেশে অবস্থান করে বিভিন্ন ঘটনার তথ্য, বিবরণ, ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করে বহির্বিশ্বে প্রচারের ব্যবস্থা ও লেখালেখি করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাকে বাংলাদেশে টেলিভিশন সাংবাদিকতার জনক বলা হয়।
পরবর্তী বিচার কার্যক্রম: ২০১০ সালে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী) মিত্রবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (জগজিৎ সিং অরোরা) এর কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
যুদ্ধের পরিণাম
অগণিত মানুষ মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারায়। প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নেয়। স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে নতুন এক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।
যুদ্ধের ফলাফল
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুধু একটি ভূখণ্ডের স্বাধীনতা নয়; এটি ছিল একটি জাতির আত্মপরিচয়ের যুদ্ধ। যদিও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে, তবুও গণহত্যা, শরণার্থী সমস্যা এবং যুদ্ধপরবর্তী পুনর্গঠন একটি চ্যালেঞ্জ ছিল।
মুক্তিযুদ্ধ এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা বাংলাদেশ ও বিশ্ব ইতিহাসে একটি মর্মান্তিক অধ্যায়। এই যুদ্ধ ছিল ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং জাতীয় স্বাধিকারের জন্য বাঙালি জাতির সংগ্রামের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজও জাতিকে প্রেরণা জোগায় এবং বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত মানুষের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে রয়ে গেছে।
ইরফান আমিন পাটোয়ারী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ
তথ্যসূত্র:
১ – রফিকুল আহমেদ (১৯৭১); মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস; বাংলা একাডেমি; ঢাকা।
২ – নুরুল আমিন সরকার; ১৯৭১: গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ।
৩ – হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত), মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র।
৪ – জর্জ হ্যারিসন, “Concert for Bangladesh” (গণহত্যার আন্তর্জাতিক প্রচারণায় ভূমিকা)।
৫ – অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান; ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা।
৬ – সাঈদ হক ও রবার্ট পেইন; The Cruel Birth of Bangladesh.
৭ – আর্চার কে ব্লাড; The Blood Telegram: India’s Secret War in East Pakistan.
৮ – New York Times (1971); “Pakistan Army’s Genocide in East Pakistan.”
৯ – Sarmila Bose (2005); Dead Reckoning: Memories of the 1971 Bangladesh War.