+8809638286662 [email protected]

ইরফান আমিন পাটোয়ারী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ

১৫২৫ এর নভেম্বর মাসের শেষের দিকের ঘটনা। কাবুলের শাসক বাবর পঞ্চমবারের মতো ভারত বিজয়ের উদ্দেশ্যে নিয়ে কাবুল ত্যাগ করলেন। কাবুল ত্যাগের সময় হয়ত তিনি নিজেও জানতেন না ভারত বিজয়ের জন্য এটাই হবে তাঁর শেষ অভিযান। এ সময় বাবরের সাথে ছিলেন আফগান, বাদাখশান, তাজিক সহ বিভিন্ন পাহাড়ি উপজাতির দুর্ধর্ষ যোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বহুজাতিক সেনাবাহিনী, যুদ্ধক্ষেত্রে যাদের দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। এদিকে পিতার ভারত যাত্রার কথা শুনে বাবরের সাথে অভিযানে অংশ নিতে পুত্র হুমায়ুন বাদাখশান প্রদেশ থেকে ছুটে আসেন। ১০ ডিসেম্বর বাবর তাঁর বহুজাতিক সেনাবাহিনী নিয়ে পেশোয়ারে প্রবেশ করেন। এরপর রাভি নদী অতিক্রম করে তিনি পাঞ্জাবে পৌঁছান।

পাঞ্জাবে প্রবেশ করা মাত্রই বাবরের সাথে তাঁর মিত্র লঙ্গর খান নিয়াজী দেখা করেন। তাঁর কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় মুসলিম জানজুয়া রাজপুতদের সাথে বাবরের মিত্রতা স্থাপন সম্ভব হয়। বাবর ইতোপূর্বে ১৫২১ সালেই গাক্কারদের বিরুদ্ধে মুসলিম জানজুয়া রাজপুতদের সহায়তা করেছিলেন। পাঞ্জাবে নিজের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে বাবর সিন্ধু নদ অতিক্রম করেন। এ সময় তাঁর বাহিনীর যোদ্ধা ছিল মাত্র ১২ হাজার। বিশাল ভারত আক্রমণের জন্য সত্যিই খুব ছোট আকারের সেনাবাহিনী এটি। কিন্তু এই বাহিনীর প্রতি বাবরের ছিলো প্রবল আত্মবিশ্বাস। বাবরের সেনাবাহিনী তাদের প্রতি তাদের সুলতানের আত্মবিশ্বাসে কখনই চিড় ধরতে দেয়নি।

ভারতের উদ্দেশ্যে কাবুল ত্যাগের পরপরই ১৫২৫ এর ১১ ডিসেম্বর দৌলত খান ও গাজী খানের নিকট থেকে বাবর একাধিক বার্তা পান। বার্তায় তাঁকে জানানো হয়, প্রায় ৩০ হাজারের একটি সেনাবাহিনী নিয়ে তাঁরা কিলানপুর থেকে লাহোর অভিমুখে যাত্রা করেছেন। বার্তা পাওয়ার দুদিন পর বাবর তাঁর সেনাবাহিনী সহ সিন্ধু নদ পাড়ি দেন। ১৫২৫ এর ২৪ ডিসেম্বর বাবর তাঁর এই ক্ষুদ্র সেনাবাহিনী নিয়ে ঝিলাম নদী অতিক্রম করেন। ঝিলাম নদী পাড়ি দেয়ার পর দৌলত খানের বিশাল সেনাবাহিনী সম্পর্কে বাবর লোকমুখে শুনতে পাচ্ছিলেন। তবে বাবর দৌলত খান লোদীর উপর কোনো ভরসাই করছিলেন না।

‘বাবরনামা’-তে বাবর উল্লেখ করেন, ‘ঐ দিন জায়গায়-জায়গায় আলোচনা চলছিল যে, গাজী খান ও দৌলত খানের পক্ষ থেকে ৩০ থেকে ৪০ হাজারের একটি বিশাল সেনাবাহিনী এগিয়ে আসছে। তবে এ কথা আমি বিশ্বাস করছিলাম না। আমার শুধু নিজের শক্তির উপরেই ভরসা ছিলো যা সেই সময়ে আমার সাথে ছিলো। আমি শুধু নিজের তরবারির শক্তির উপরেই ভরসা করছিলাম।’

১৫২৫ এর ২৬ ডিসেম্বর বাবর চেনাবে পৌঁছান। চেনাব থেকে সামনের দিকে অগ্রসরের সময় বাবর আবারো স্থানীয় উপজাতিগুলোর বিরুদ্ধে ছোটখাটো অভিযান চালাতে বাধ্য হন। ৩১ ডিসেম্বর বাবর কলাভারে পৌঁছান। এখানে জানী বেগ, শাহ হাসান, মাহমুদ মির্জা আর আদিল হাসান অল্প কিছু সংখ্যক করে সৈন্য নিয়ে মূল বাহিনীর সাথে যোগ দিলেন। এরপরের দিন, অর্থাৎ, ১৫২৬ এর ১ জানুয়ারী, বাবর মেওয়াত গিয়ে পৌঁছান। বাবরের মেওয়াতে অবস্থানের সময়ই তাঁর পুত্র হুমায়ুন তাঁর সাথে এসে মিলিত হন।

ভারত বিজয়ের উদ্দেশ্যে বাবর দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে আসছেন, এই খবর কিন্তু ইব্রাহীম লোদীর অজানা ছিলো না। তাই তিনি বাবরকে বাঁধা দিতে হিসার ফিরোজার হামিদ খানের নেতৃত্বে একটি বাহিনী পাঠালেন। আম্বালায় পৌঁছানোর পর বাবর এই বাহিনী সম্পর্কে জানতে পারেন। ইব্রাহীম লোদী এ সময় মূল সেনাবাহিনী নিয়ে দিল্লীর উত্তর দিকে অবস্থান করছিলেন। বাবর শাহজাদা মীর্জা হুমায়ুনের নেতৃত্বে ছোট একটি বাহিনীকে হিসার ফিরোজার দিকে যাত্রা করতে নির্দেশ দেন। হিসার ফিরোজা থেকে ২৫/৩০ মাইল দূরে হামিদ খানের সাথে বাবরপুত্র মীর্জা হুমায়ুন মুখোমুখি হন। অল্প সময়ের মধ্যেই শাহজাদা মির্জা হুমায়ুন যুদ্ধে জয়ী হন। নিজের পুত্র হুমায়ুনের যুদ্ধ জয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বাবর তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেন, ‘এটা ছিলো হুমায়ুনের প্রথম যুদ্ধজয় ও প্রথম যুদ্ধের অভিজ্ঞতা। হুমায়ুনের বাহিনী হামিদ খানের হস্তীবাহিনীর ৭/৮টি হাতি আর প্রায় ১০০ সেনা বন্দী করে নিয়ে এলো।’ নিজের প্রথম এ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা লাভের সময় হুমায়ুনের বয়স ছিলো মাত্র ১৭ বছর।

হিসার ফিরোজায় হুমায়ুনের জয়লাভের পর বাবর দক্ষিণ দিকে তাঁর অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখেন। বাবরকে বাঁধাদানের জন্য ইব্রাহীম লোদী আবারো দাউদ খান লোদী ও হাতিম খান লোদীর নেতৃত্বে ৬ হাজার সৈন্যের একটি সেনাবাহিনী পাঠান। এই বাহিনীকে মোকাবেলার জন্য বাবর জুনায়েদ মির্জা, মীর হুসাইন, কুতল কদম আর কিন্তা বেগের নেতৃত্বে একটি বাহিনী পাঠিয়ে দেন। ইব্রাহীম লোদী সত্যিকার অর্থেই দুর্ভাগা ছিলেন। কারণ অতর্কিত আক্রমণে ইব্রাহীম লোদীর এ বাহিনীটিও পরাজিত হয়। এ যুদ্ধে দাউদ খান, হাতিম খানসহ প্রায় ৬০-৭০ জন সৈন্য যুদ্ধবন্দী হিসেবে বাবরের বাহিনীর হাতে আসে। এছাড়া যুদ্ধে ৬/৭টি যুদ্ধহাতি আটক করা সম্ভব হয়।

বাবর সামনে এগিয়ে যেতে থাকলেন। ১৫২৬ এর ১২ এপ্রিল তিনি উত্তর-পশ্চিম ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের “পানিপাত” নামক জেলার একটি শহরে পৌঁছান। জায়গাটি ইতিহাসে পানিপথের প্রান্তর নামে পরিচিত। বাবরের যাত্রাপথে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাহিনী এসে তাঁর বাহিনীতে যোগ দেয়। পানিপথের প্রান্তরে এসে পৌঁছানোর সময় বাবরের সেনাবাহিনীর আকার ২৫,০০০-এ গিয়ে পৌঁছায়। ইব্রাহীম লোদী এ সময় বাবরের থেকে মাত্র প্রায় ১২ মাইল দূরে অবস্থান করছিলেন। বাবর সেনাপতিদের সাথে আলোচনা করে পানিপথের প্রান্তরেই ইব্রাহীম লোদীকে মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাবর তাঁর সারা জীবনে অসংখ্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন কিংবা পরোক্ষভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু সুশৃংঙ্খল কোনো সেনাবাহিনী বা সত্যিকার অর্থে কোনো সাম্রাজ্যকে মোকাবেলা করার অভিজ্ঞতা বাবরের ছিল না। আর তাই পানিপথের এই যুদ্ধটি বাবরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।

বাবরকে বাঁধা দেয়ার জন্য ইব্রাহীম লোদী প্রায় এক লাখের একটি বিশাল সেনাবাহিনীর সমাবেশ ঘটান। সাথে ছিলো প্রায় ১,০০০ এর মত হাতি। প্রাচীনকাল থেকেই হাতি ভারতের যুদ্ধগুলোতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। হাতির বিশাল আকার আর উদ্ভট চিৎকারে বিপক্ষ দলের ঘোড়াগুলো ঘাবড়ে যেত। কোনোমতেই ঘোড়াগুলোকে হস্তীবাহিনীর সামনে নেয়া যেতো না, যার ফলে শত্রুপক্ষের অশ্বারোহী বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতো। বাবর অগ্রসর হওয়ার সময়েই ইব্রাহীম লোদীর বিরাট সেনা সমাবেশের কথা শুনছিলেন। একদিকে ইব্রাহীম লোদীর সেনাবাহিনীর বিরাটাকার বাবরের জন্য সত্যিকার অর্থেই চিন্তার বিষয় ছিল। তার উপরে আবার আছে হস্তি বাহিনীর উপদ্রব।

‘বাবরনামা’-তে বাবর লিখেছেন। ‘শত্রু সেনাদের সম্পর্কে বড় বড় কথা আসছিল যে, এক লাখের একটি বাহিনীসহ প্রায় ১ হাজার হাতির সমাবেশ তাঁরা ঘটিয়েছে। এসব শুনে আমার সৈন্যদের মনোবল নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তাদের সাহস ছিলো অটুট।’

ইব্রাহীম লোদীর বিশাল সেনাবাহিনীর মোকাবেলায় বাবরের বাহিনী সত্যিকার অর্থে নিতান্তই কম ছিল। আর তাই ইব্রাহীম লোদীকে মোকাবেলার জন্য বাবরকে উন্নত কৌশলের উপরে নির্ভর করতে হয়েছিল। বাবরের প্রাথমিক কৌশলটি ছিলো অনেকটা অটোমান তুর্কিদের মত। তুর্কি পদ্ধতিতে তিনি গরু আর ঘোড়ার গাড়িগুলোকে চামড়ার দড়ির সাহয্যে পাশাপাশি বেঁধে একটি প্রাথমিক বাঁধা তৈরি করেন। গাড়িগুলোর মাঝে আবার অনেকটা জায়গা জুড়ে ফাঁদ পাতা থাকত। এসব ফাঁদের পেছনে বাবর তাঁর সৈন্যদের মোতায়েন করেন। অটোমান সেনাবাহিনী গাড়িগুলোকে বাঁধতো লোহার তৈরি চেইনের সাহায্যে। এই কৌশলকে বলা হতো “আরাবা”।

তীরন্দাজ আর পদাতিক সৈন্যদের মাঝেও বাবর একটি সরুপথ খোলা রাখেন, যেন যুদ্ধের সময় বিপক্ষ দলের সৈন্যরা এই সরুপথে এসে আটকে যায়। হস্তী বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য বাবর নিজ বাহিনীর অবস্থানের সামনে একটি পরিখা খনন করান। পরিখাটি গাছ-লতাপাতা দিয়ে ঢেকে রাখেন যেন দূর থেকে বোঝা না যায়। আর পরিখার ডান ও বামপাশ বরাবর নিয়োজিত করেন একদল দক্ষ সৈন্যকে, যাদের মূল কাজ ছিলো আক্রমণ শুরু হলে যুদ্ধক্ষেত্রের পার্শ্বদেশ দিয়ে সামনে এগিয়ে ইব্রাহীম লোদীর বাহিনীর পেছন দিক দিয়ে ঘিরে আক্রমণ করা।

ভারতে বাবর একটি নতুন অস্ত্র নিয়ে আসেন, যাকে আমরা এখন কামান নামে চিনি। বাবরের নিয়ে আসার পূর্বে ভারত কখনো কামান দেখেনি। ভারতবাসীর কামানের গর্জন শোনা ছিল নতুন এক অভিজ্ঞতা। তবে এটাও সত্য, বাবরের সময়ের কামানগুলোর কার্যকারীতা খুব অল্প ছিল। এসব কামানের পাল্লা খুব অল্প ছিল, গোলার বিষ্ফোরণ ক্ষমতা অল্প ছিল। একটি গোলা ছোড়ার পর আরেকটি গোলা ছোড়ার জন্য পুনরায় কামানকে প্রস্তুত করতে অনেক সময় লেগে যেত। কিন্তু তাও বাবরের কামান একটি স্বতন্ত্র ক্ষেত্রে এই যুদ্ধে তার কার্যকারীতা প্রমাণ করে। বাবর তাঁর কামানগুলো সংগ্রহ করেছিলেন উসমানীয় সুলতানের কাছ থেকে। ইব্রাহীম লোদীর কাছে যেহেতু কোনো কামান ছিল না, তাই বাবর নিশ্চিতে ‘আরাবা’ কৌশলের নিরাপত্তায় তাঁর কামানগুলোকে মোতায়েন করে দেন। বাবরের কামানগুলোকে পাল্টা আক্রমণের জন্য ইব্রাহীম লোদীর কোনো আর্টিলারী ব্যাকআপ ছিল না বিধায় কামানগুলো কোনোরুপ বাঁধা ছাড়াই যুদ্ধক্ষেত্রে গোলা নিক্ষেপ করতে সক্ষম হয়েছিল।

পানিপথের এ যুদ্ধে বাবর প্রায় ২০-২৪টি কামান ব্যবহার করেছিলেন বলে জানা যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইব্রাহীম লোদীর সৈন্যরা দূর থেকে কামানগুলোকে দেখে উন্নত ধরনের তীর-ধনুকের মতো অস্ত্র ভেবেছিল। এই যুদ্ধে আরেকটি নতুন অস্ত্র বাবর ব্যবহার করেন। কামানের মতোই দেখতে কিন্তু আকারে ছোট বন্দুক জাতীয় এক ধরনের অস্ত্র তিনি এ যুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন। এই বন্দুককে বলা হতো ‘ম্যাচলক’। তবে বাবরের সৈন্যরা ম্যাচলক অপেক্ষা তীর-ধনুকে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো। কারণ ধনুক থেকে খুব সহজে আর বেশি মাত্রায় তীর নিক্ষেপ করা যেত, যা প্রথমদিকের ম্যাচলক বন্দুকে করা যেত না। বাবরের আর্টিলারী কোরের দায়িত্বে ছিলেন অটোমান ওস্তাদ আলী কুলি খান। আর ম্যাচলকধারী সৈন্যদের নেতৃত্বে ছিলেন অটোমান মোস্তফা রুমি।

যুদ্ধ শুরুর আগেই বাবর তাঁর বাহিনীকে মোট ছয়টি ভাগে ভাগ করে ফেলেন। মূল বাহিনী, মধ্য বাহিনী, ডানবাহু, বামবাহু, অগ্রবর্তী বাহিনী ও রিজার্ভ বাহিনী। সেনাবাহিনীর অবস্থানের আশেপাশের এলাকার নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য ছিলো একটি বিশেষ প্রহরী বাহিনী। ডানপাশের বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন শাহজাদা হুমায়ুন মির্জা। যুদ্ধে অনভিজ্ঞ মির্জা হুমায়ুনকে সহায়তা করার জন্য বাবর হুমায়ুনের সাথে অভিজ্ঞ খাঁজা কঁলা, সুলতান মুহাম্মদ আর হিন্দু বেগের মতো অভিজ্ঞ সেনাপতিদের হুমায়ুনকে সহায়তা করার জন্য নির্দেশ দেন। বাহিনীর বাম অংশের নেতৃত্বে ছিলেন বাবরের আত্মীয় সুলতান মির্জা, মুহাম্মদ মির্জা, মুহাম্মদ খাঁজা, আদিল সুলতান শাহ, মীর হুসাইন, জুনাইদ মির্জা, কুতলক কদম, জানী বেগ আর শাহী হুসাইনের মতো অভিজ্ঞ জেনারেলরা। ডান এবং বাম অংশকে সহায়তা করার জন্য বাবর আরো দুটি ক্ষুদ্র বাহিনীকে রিজার্ভ হিসেবে রাখেন। অগ্রবর্তী বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন খসরু কুকুলদাস আর মুহাম্মদ আলী জং। আর অশ্বারোহী বাহিনীর নেতৃত্ব ছিলো আবদুল আজিজের কাছে। পানিপথে অবস্থানের পুরোটা সময় মুঘল সেনাবাহিনী যুদ্ধের ফর্মেশনে থাকত।

মূল যুদ্ধ শুরুর আগে দুই বাহিনী প্রায় ৭ দিন মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ কাউকে আক্রমণ করছিল না। অপেক্ষাকৃত দুর্বল হওয়ায় বাবর নিজে প্রথমে আক্রমণ শুরু করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি বিভিন্নভাবে ইব্রাহীম লোদিকে আক্রমণ শুরুর জন্য প্ররোচনা দিতে থাকেন। কিন্তু ইব্রাহীম লোদীও প্রথমে আক্রমণ না করার ব্যাপারে অনড় থাকেন। আসলে ইব্রাহীম লোদীর জন্য এই যুদ্ধটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো যুদ্ধ ছিলো না। কারণ এই যুদ্ধে বিজয়ী হলেও ইব্রাহীম লোদির অর্জন বলতে তেমন কিছুই হতো না। এ যুদ্ধে ইব্রাহীম লোদীর একমাত্র লক্ষ্য ছিলো বাবরকে পরাজিত করে তাঁর বাহিনীকে কাবুলের দিকে ঠেলে দেয়া, যেন এই আপদকে বিদায় করতে পারলেই তিনি বেঁচে যান।

৭ দিন অবস্থান নিয়ে অপেক্ষা করেও মূল যুদ্ধ শুরু না হওয়ায় বাবর ইব্রাহীম লোদীকে আবারো প্ররোচিত করতে একটি ছোট আক্রমণ পরিচালনা করেন। এই উদ্দেশ্যে বাবর ৪ বা ৫ হাজার সৈন্যের একটি ক্ষুদ্র বাহিনীকে ২০ এপ্রিল রাতে ইব্রাহীম লোদীর সেনা অবস্থানের নিকট পাঠান। কিন্তু ইব্রাহীম লোদীকে প্ররোচণা দিতে গিয়ে বাবরের এই বাহিনীটি ব্যর্থ হয়ে মূল সেনাবাহিনী থেকে আলাদা হয়ে যায়। সফল হওয়ার সম্ভাবনা দেখে ইব্রাহীম লোদী পরের দিন সকালের দিকে তাঁর মূল বাহিনী নিয়ে সামনে এগিয়ে আসেন। বাবর তাঁর পুত্র হুমায়ুনকে অগ্রবর্তী বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সেনাদের উদ্ধারে পাঠিয়ে নিজে মূল বাহিনী নিয়ে সামনে এগিয়ে যান।

১৫২৬ এর ২১ এপ্রিল ইব্রাহীম লোদি তাঁর বাহিনীর নিশ্চল অবস্থা ছেড়ে বাহিনী নিয়ে সামনে এগিয়ে আসেন। আগের রাতে বাবরের সেনাবাহিনীর আক্রমণটি ব্যর্থ হওয়ায় ইব্রাহীম লোদী আত্মবিশ্বাস ফিরে পান। তিনি প্রচন্ড একটি আক্রমণের মাধ্যমে বাবরকে পরাজিত করে ভারত থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টাতেই ছিলেন। ইব্রাহীম লোদী প্রথমেই বাবরের সেনাবাহিনীর ডান অংশের উপরে আক্রমণ পরিচালনা করেন। বাবরের রিজার্ভ সৈন্যরা ডান বাহুকে সহায়তা করে আক্রমণ ঠেকিয়ে দেয়। হঠাৎ করে থেমে যাওয়ায় লোদীর বাহিনীর পেছন থেকে সামনের অংশে চাপ বেড়ে যায়, ফলে সামনের সৈন্যরা অসুবিধায় পড়ে যাচ্ছিল। আর এদিকে বাবর তাঁর সেনাদের নিয়ে গাড়ির ফাঁদের মাঝ থেকে ইব্রাহীম লোদীর বাহিনীর উপরে ক্রমাগত আক্রমণ করে যাচ্ছিলেন। ফলাফল এই দাঁড়ায়, প্রায় বিনা প্রতিরোধে লোদী সৈন্যরা মারা যেতে থাকেন।

পানিপথের এই যুদ্ধে বাবর তুর্কী ‘তুগুলাম’ কৌশলের সফল প্রয়োগ ঘটান। কৌশলটি হচ্ছে- গোটা সেনাবাহিনীকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে আক্রমণ পরিচালনা করা। বিপক্ষ দলের আক্রমণের মুখে পিছু হটে পালানোর ভান ধরে হঠাৎই ঘোড়া থেকে মুখ ঘুরিয়ে তীর ছুড়ে মারা এবং সেই সাথে শত্রু বাহিনীকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলা। বাবরের ‘তুগুলামা’ ও ‘আরাবা’ কৌশলের সফল প্রয়োগে ইব্রাহীম লোদীর বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে উঠে, কারণ ইতিপূর্বে তারা এই কৌশলের সাথে পরিচিত ছিল না। এই তুগুলামা কৌশলটির সফল প্রয়োগে ব্যর্থ হয়ে ১১৯১ সালে তরাইনের প্রথম যুদ্ধে মুহাম্মদ ঘুরী পৃথ্বিরাজ চৌহানের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। আর পরের বছর, অর্থাৎ, ১১৯২ সালে এই কৌশলের সফল প্রয়োগের মাধ্যমেই তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে মুহাম্মদ ঘুরী পৃথ্বিরাজ চৌহানকে পরাজিত করেন।

যাইহোক, ইতোমধ্যে পরিখার দুইপার্শ্বে নিয়োজিত বাহিনী, যাদের মোতায়েন করা হয়েছিল মূল যুদ্ধ এড়িয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের দুইপাশ দিয়ে এগিয়ে যেয়ে ইব্রাহীম লোদীর বাহিনীর পেছনের অংশে আক্রমণ চালানোর জন্য, তারা তাদের কাজ শুরু করে দেয়। একইসাথে লোদী বাহিনীর উপর তীব্রমাত্রায় তীরবর্ষণ চলতে থাকে। যুদ্ধের এ পর্যায়ে কার্যত ইব্রাহীম লোদীর বাহিনী মুঘল সৈন্যদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে যায়। সত্যিকার অর্থে, এই কৌশলের তীব্র আক্রমণে ইব্রাহীম লোদী হতবুদ্ধি হয়ে পাল্টা কোনো আক্রমণের সক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেন।

মুঘল সৈন্যরা ইব্রাহীম লোদীর বাহিনীকে তিনদিক থেকেই ঘিরে ধরলে এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে ইব্রাহীম লোদী তাঁর হস্তি বাহিনীকে সামনে এগিয়ে দেন। কিন্তু হস্তি বাহিনী পরিচালনা করেও তিনি তেমন সুবিধা করতে পারেন নি। কারণ হস্তী বাহিনী পরিচালনার সাথে সাথেই বাবরের কামানগুলো একসাথে গর্জে উঠে। ভারতের এ হাতিগুলো কোনোদিনই কামানের বিকট গর্জন শোনেনি। কামানের গর্জনে তারা ভয় পেয়ে যুদ্ধ বিন্যাস ছেড়ে ছোটাছুটি শুরু করতে থাকে আর নিজেদের সৈন্যদেরই পিষ্ট করতে থাকে। যদিও কামানের গোলাগুলো তেমন বিষ্ফোরণক্ষম আর কার্যকর ছিল না, কিন্তু কামানের শব্দই গোলার থেকে বেশি কার্যকর প্রমাণিত হয়। কামানের এই বিকট শব্দের কারণেই ইব্রাহীম লোদীর হস্তি বাহিনী বিধ্বস্ত হয়।

‘বাবরনামা’-এর বর্ণনানুযায়ী, ‘শত্রুদের হস্তী বাহিনী তোপের (কামান) শব্দে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পিছু হটে নিজেদের সৈন্যদেরই পদদলিত করতে লাগলো। তখন শত্রু বাহিনীতে ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল। এতে শত্রু বাহিনীর অনেক সৈন্যই পদদলিত হয়ে মারা গেল।’

যুদ্ধক্ষেত্রে ইব্রাহীম লোদীর বাহিনী মুঘল সেনাদের সামনে অসহায় হয়ে পড়েছিল। এর আসল কারণ অবশ্য টের পাওয়া যায় আরো পরে। প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই ইব্রাহীম লোদী কামানের গোলায় আহত হয়ে মারা যান, লোদীর সেনাপতি বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সৈন্য পরিচালনার কোনো চেষ্টা বা তাদের অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে বের করার কোনো চেষ্টা না করেই পলায়ন করেন। এর কারণও বোঝা যায় যুদ্ধ শেষের পরে। বেতন বাকী থাকায় ইব্রাহীম লোদীর সৈন্য ও সামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল। তাই তারা এই যুদ্ধে তেমন আগ্রহী ছিল না। ইতোমধ্যে যুদ্ধ শুরুর পূর্বেই লোদীর বহু সৈন্য আর জেনারেল তার পক্ষ ত্যাগ করে চলে যায়, আর বাহিনীর উল্ল্যেখযোগ্য সৈন্য যুদ্ধে অংশই নেয়নি।

ফলাফল অবশেষে এই দাঁড়ায়, পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহীম লোদী পরাজিত হলেন, আর বাবরের সামনে ভারতের ভূখন্ডগুলো উম্মুক্ত হয়ে গেল। ইব্রাহীম লোদীর পরাজয় প্রসঙ্গে বাবর তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘তিনি (ইব্রাহীম লোদী) অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে আমাদের বাহিনীর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু তিনি আমাদের রক্ষা ব্যূহের ব্যপারে কোনো ধারণাই রাখতেন না। তিনি তরুণ ছিলেন, অনভিজ্ঞ ছিলেন। আমাদের সামরিক দক্ষতা সম্পর্কে তিনি সামান্যতম ধারণাও অর্জন করতে পারেন নি। তিনি জানতেন না, যুদ্ধক্ষেত্রে কীভাবে সেনা বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।’

মূলত এই যুদ্ধে ইব্রাহীম লোদীর পরাজয়ের কারণ ছিল বাবরের উন্নত কৌশলের জবাবে উপযুক্ত কৌশলের প্রয়োগ না ঘটাতে পারা, উন্নত অস্ত্রশস্ত্রের অভাব, সেনাদের মনোবল আর ত্যাগ করার মানসিকতার অভাব। অন্যদিকে বাবরের সেনা বাহিনী এসব স্বীমাবদ্ধতা থেকে অনেকাংশে মুক্ত ছিল, মুঘল সেনা বাহিনীর দক্ষতা আর আনুগত্য ছিলো প্রশ্নাতীত। উপরন্তু পানিপথের এই যুদ্ধে বাবর টেরেইন বা যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থানগত প্রত্যেকটি সুবিধার সফল প্রয়োগ ঘটাতে সক্ষম হন, যে ক্ষেত্রে ইব্রাহীম লোদী চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেন। একইসাথে আকারে বড় হওয়ায় বাহিনীর উপরে তাঁর নিয়ন্ত্রণ ছিলো অনেকাংশে দুর্বল। এই দুর্বলতা কাটিয়ে নেয়া যেত যদি তাঁর সামরিক অফিসাররা নিবেদিত প্রাণ হয়ে যুদ্ধ করতো। কিন্তু তারা তা করেনি।

আসলে ইব্রাহীম লোদীর প্রতি সত্যিকার অর্থে বিশ্বস্ত সৈন্যের অভাব ছিল খুব বেশি, যার কারণে ১ লাখের একটি সেনা বাহিনী নিয়েও শুধু আন্তরিকতা আর আনুগত্যের অভাবে দুর্বল একটি বাহিনীর কাছে ইব্রাহীম লোদী পরাজিত হলেন। তারপরেও ইব্রাহীম লোদী যদি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আর কিছুক্ষণ যুদ্ধ পরিচালনায় সক্ষম হতেন, তাহলে হয়তো পানিপথের প্রথম যুদ্ধের ফলাফল ভিন্ন হত। কারণ বাবর ইতোমধ্যে তাঁর সবগুলো রিজার্ভ ফোর্সকে যুদ্ধে মোতায়েন করে ফেলেছিলেন, আর অন্যদিকে ইব্রাহীম লোদী তাঁর মূল সেনা বাহিনীর একটি বিরাট অংশকে যুদ্ধে মোতায়েনই করতে পারেননি, অন্য অংশগুলোর কথা তো বলাই বাহুল্য।

যুদ্ধ শেষে ইব্রাহীম লোদীর মৃতদেহ অন্যান্য সৈন্যদের সাথে খুঁজে পাওয়া যায়। বাবর নিজে একজন জাত যোদ্ধা ছিলেন। একজন প্রকৃত যোদ্ধা কখনোই অন্য কোনো যোদ্ধাকে অসম্মান করতে পারেন না। হোক সে শত্রু কিংবা মিত্র। আর তাই বাবর ইব্রাহীম লোদীর মৃতদেহকে কোনো প্রকার অসম্মান না করে পূর্ণ মর্যাদার সাথে তাঁর নিহত হওয়ার স্থানেই তাকে সমাহিত করেন। ইব্রাহীম লোদীর বাহিনীর হিন্দু যোদ্ধাদের তাদের নিজেদের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ীই সৎকার করার অনুমতি দেন।

পানিপথের এই যুদ্ধে মুঘল সেনা বাহিনীর প্রায় ৪,০০০ সৈন্য নিহত হন। অপরদিকে ‘বাবরনামা’ এর বর্ণনা অনুযায়ী ইব্রাহীম লোদীর ১৫-২০ হাজার সৈন্য এ যুদ্ধে প্রাণ হারায়। তবে বাবর আগ্রা পৌঁছানোর পর জানতে পারেন পানিপথের প্রান্তরে দিল্লী সেনা বাহিনীর নিহত সৈন্যসংখ্যা ছিলো প্রায় ৪০-৫০ হাজার।

পানিপথের প্রথম যুদ্ধে জয়ী হয়ে ঐ দিনই বাবর দিল্লী অভিমুখে একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। আর পুত্র হুমায়ুনকে পাঠান আগ্রা অধিকারের জন্য। এসময় হুমায়ুনের সাথে শাহ মনসুর, ইউনুস আলী, আবদুল্লাহ খ্বাজা অবস্থান করছিলেন। দিল্লীগামী বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন মুহাম্মদ খ্বাজা, মুহাম্মদ মির্জা, আদিল সুলতান, জুনাইদ মির্জা আর কুতলক কদম। তাদের উপর নির্দেশ ছিল দিল্লীর রাজকোষের নিরাপত্তা বিধান করা। দিল্লীগামী বাহিনীটি খুব সহজেই দিল্লীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। বাবর দিল্লী পৌঁছেছিলেন ২৫ এপ্রিল সকালের দিকে। এ দিনই বাবর গিয়াসউদ্দীন বলবন আর ভারতের একসময়ের প্রতাপশালী শাসক আলাউদ্দীন খিলজির বাসভবন পরিদর্শন করেন। ২৬ এপ্রিল বাবর তুঘলকাবাদ পরিদর্শন করেন। ২৭ এপ্রিল দিল্লীতে মাওলানা মাহমুদ আর শায়খ জেন বাবরের নামে খুতবা পাঠ করেন। ভারত বিজয় উপলক্ষে বাবর দিল্লীর রাজকোষের একটি বিশাল অংশ গরীব ও দুঃখীদের মাঝে বন্টন করে দেন। এরপরের দিন, অর্থাৎ, ১৫২৬ সালের ২৮ এপ্রিল বাবর আগ্রার দিকে যাত্রা করেন।

এদিকে, ৪ মে হুমায়ুন আগ্রা শহরটি অবরোধ করেন। বাবরের আগ্রা পৌঁছানোর আগেই, খুব দ্রুতই আগ্রার পতন ঘটে। এরপর একে একে জৈনপুর, কালপি ও জব্বলপুরে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আগ্রা দখলের পর বাবর আগ্রা পৌঁছালে হুমায়ুন বাবরকে আগ্রার সমস্ত দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। আগ্রার রাজকোষের পাশাপাশি হুমায়ুন বাবরকে আরেকটি বহুমূল্যবান বস্তু প্রদান করেছিলেন। আর তা হলো সেই কিংবদন্তীতুল্য কোহিনূর হীরা। হুমায়ুন হীরাটি গোয়ালিয়রের রাজা বিক্রমাদিত্যের পরিবারের থেকে পেয়েছিলেন। রাজা বিক্রমাদিত্য ইব্রাহীম লোদীর সাথে পানিপথের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রেই মারা যান। এসময় তার স্ত্রী আর সন্তানরা আগ্রাতে অবস্থান করছিলেন। মুঘল সেনা বাহিনী তাদের পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদান করেছিল।

যাইহোক, কোহিনূর হীরাটি বাবরের সামনে পেশ করা হলে তিনি হীরাটি তাঁর পুত্রকে উপহার হিসেবে প্রদান করেন। এছাড়া বাবর সেনা বাহিনীর প্রত্যেক সেনাপতি থেকে শুরু করে সব সৈন্যের মাঝেই গণিমতের সম্পদ বন্টন করে দেন। কাবুলে বাবরের অন্যান্য আত্মীয়স্বজন ও পুত্রদের জন্যও উপহার হিসেবে স্বর্ণমুদ্রা, রৌপ্যমুদ্রা ও মূল্যবান রত্নসামগ্রী পাঠানো হয়। এমনকি গণিমতের একটি বিশাল অংশ বাবরের জন্মভূমি ফারগানা, সমরকন্দ, খোরাসান, কাশগড়, পারস্য, হেরাতসহ মক্কা এবং মদীনাতে পাঠান। রাজকোষের অবশিষ্ট অংশ সেনা বাহিনী পুনর্গঠন আর রাজ্যের উন্নয়নের জন্য সঞ্চয় করেন। ভারত বিজয়ের পর সবাইকে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী বিভিন্ন পরিমাণ সম্পদ ভাগ করে দিলেও বাবর নিজে এই সম্পদ থেকে কিছুই গ্রহণ করেননি। একটি মুদ্রাও না। এমনকি সারা পৃথিবীর বিস্ময় কোহিনূর হীরাটিও তিনি তাঁর পুত্র হুমায়ুনকে দান করে দিয়েছিলেন। হিন্দুস্তানে বাবরের এই সম্পদের প্রতি নির্লোভ স্বভাব তাকে বিশেষ সম্মান আর খ্যাতি এনে দিয়েছিল।

রাজা বিক্রমাদিত্যের পরিবারের পাশাপাশি আগ্রায় ইব্রাহীম লোদীর বেশ কিছু আত্মীয় আর বিশ্বস্ত লোকজন অবস্থান করছিলেন। এদের মাঝে ইব্রাহীম লোদীর মা, মালিকদাদ করঘানী, সির্দুক আর ফিরোজ খান মেওয়াতি উল্লেখযোগ্য ছিলেন। বাবর তাদের সবাইকেই পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদান করেন। তাদের মুক্ত করে দেয়া হয়। এমনকি সবাইকে বিভিন্ন পরগণার দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হয়। ইব্রাহীম লোদীর মা তৎকালীন সময়ের ৭ লাখ হিন্দুস্তানী মুদ্রার সম মূল্যমানের একটি পরগণা নিজের নামে পেয়েছিলেন। ১৫২৬ সালের ১০ মে এর মধ্যেই সমগ্র দিল্লী আর আগ্রা বাবরের নিয়ন্ত্রণে আসে।

পানিপথের প্রান্তরে ভাগ্যবিড়ম্বনায় জর্জরিত কাবুলের সুলতান জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর এবং দিল্লীর লোদী রাজপরিবারের ইব্রাহীম খান লোদীর মধ্যকার এ যুদ্ধটি পানিপথের প্রথম যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। এ যুদ্ধের পর অখ্যাত পানিপথের এ প্রান্তরটি রাতারাতি ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে যায়। কারণ ইব্রাহীম লোদী এবং বাবরের মধ্যকার এ যুদ্ধটি ছিলো ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া একটি যুদ্ধ। যদি এ যুদ্ধে বাবর পরাজিত হতেন, বা পানিপথের যুদ্ধ নামে কোনো যুদ্ধ কখনো সংগঠিতই না হতো, তাহলে ভারতের ইতিহাস নিশ্চিতভাবেই অন্যরকম হত। কিন্তু পানিপথের যুদ্ধটি সংগঠিত হয়েছিল এবং এ যুদ্ধে বাবর জয়লাভ করেছিলেন। বাবর নাগাল পেয়েছিলেন তাঁর স্বপ্নের ভারতের, যেখানে তিনি তাঁর ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য রেখে যাবেন উন্নয়নের অপেক্ষায় থাকা সমৃদ্ধিশালী একটি সাম্রাজ্য। তাঁরা নিজেদের মতো করে ভারতের ভূখন্ডগুলোকে সাজাবেন। বাবর এবং তাঁর বংশধরদের বীরত্বের কথা কিংবদন্তীর ন্যায় চারদিকে ছড়াতে থাকবে।

তবে, বাবর কিন্তু শুরুতে নিজে সরাসরি ভারতের অধিপতি হয়ে বসতে চাননি। বরং তিনি চেয়েছিলেন তাঁর অধীনে তাঁর বিশ্বস্ত অন্য কেউ ভারত শাসন করুক। একারণে শুরুতেই বাবরের পছন্দের তালিকায় ছিলেন ইব্রাহীম লোদীর চাচা আলম খান। কিন্তু ভারতে বাবরের অন্যান্য মিত্ররা আলম খানের ব্যপারে দ্বিমত পোষণ করেন। বাবরের হাতে আরেকটি পছন্দ ছিল। তিনি হলেন দৌলত খান লোদী। কিন্তু দৌলত খান লোদীর মতিগতি বাবরের কাছে তেমন ভালো লাগছিল না। এমনকি তিনি বেশ কয়েকবারই বাবরের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। আর তাই বাবর দৌলত খান লোদীকেও বাদ দিয়ে দিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেই ভারতের সিংহাসনে বসার সিদ্ধান্ত নেন। সে যাইহোক, পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবর বিজয়ী হয়েছেন। ভারতের দরজা এখন বাবরের জন্য উন্মুক্ত। বাবরের জন্য আর পিছনে তাকানোর সুযোগ নেই। তাঁকে সামনের দিকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ, শত্রুরা এখনো বাবরকে ভারত ছাড়া করতে সংগঠিত হচ্ছে। আর মুঘল ঘোড়াগুলো অস্থিরভাবে পায়চারী করছে ভারতের উন্মুক্ত মাটিতে ছুটে বেড়ানোর জন্য।

তথ্যসূত্র:

–> Chandra, Satish. Medieval India: From Sultanat to the Mughals. Har-Anand Publications, 1997.

–> Richards, John F. The Mughal Empire. Cambridge University Press, 1993.

–> Jackson, Peter. The Delhi Sultanate: A Political and Military History. Cambridge University Press, 1999.

–> Spear, Percival. A History of India, Volume 2. Penguin Books, 1990.

–> Eraly, Abraham. Emperors of the Peacock Throne: The Saga of the Great Mughals. Penguin Books, 2000.

–> বাবরনামা – জহির উদ দিন মুহাম্মদ বাবুর (অনুবাদ: মুহাম্মদ জালালউদ্দীন বিশ্বাস)

–> হুমায়ুননামা – মূল: গুলবদন বেগম (অনুবাদ: ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ)

–> মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায় – (সাহাদত হোসেন খান)