মুন্সীগঞ্জ শহরে অবস্থিত মুঘল স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন ইদ্রাকপুর জলদুর্গ, ১৬৬০ সালে তৎকালীন বাংলায় নিযুক্ত মুঘল সেনাপতি মীর জুমলা নির্মান করেন। ইছামতি নদীর তীরে অবস্থিত দুর্গটি তৎসময়ে ঢাকা ও নারায়নগঞ্জ শহরকে মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুর আক্রমনের হাত থেকে বাঁচাবার উদ্দেশ্যে তৈরী।
উপকূল হতে ছিপ নৌকা নিয়ে আরাকান মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুরা নদীপথে মেঘনা ➤ধলেশ্বরী মোহনা➤ শীতলক্ষ্যা নদী ধরে এগিয়ে ধোলাই খাল হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করতো। মীর জুমলা জলদস্যুদের এই হঠাৎ আক্রমন ঠেকাতে তিন স্তরের বেষ্টনী তৈরীর উদ্যোগ নেন, এগুলো হল: ১. ইদ্রাকপুর দুর্গ, ২. সোনাকান্দা দুর্গ, ৩. হাজিগঞ্জ দুর্গ।
এছাড়াও বারভূঁইয়াদের মধ্যে মুন্সিগঞ্জের স্থানীয় শাসক চাঁদ রায় ও কেঁদার রায়ের সাথে মুঘলদের তীব্র বিরোধ ছিল। ১৬১১ সালে ডাকচেরা ও যাত্রাপুর দুর্গে মুঘলদের কাছে তাদের পরাজয় ঘটে যার ফলশ্রুতিতে সমগ্র বিক্রমপুর মুঘলদের শাসনে চলে যায়। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর মুঘল পতন ঘটলে এই দুর্গের ক্ষমতা চলে যায় ইংরেজদের নিয়ন্ত্রনে।
নির্মানশৈলী-
ইদ্রাকপুর জলদুর্গটি আয়তনে হাজীগঞ্জ ও সোনাকান্দা জলদুর্গের তুলনায় কিছুটা ছোট। আয়তাকার এই দুর্গের দৈর্ঘ্য ৮৬.৮৭ মিঃ এবং প্রস্থ ৫৯.৬০ মিঃ। মুঘল স্থাপত্য ছাড়াও দুর্গের ভেতরের অন্যান্য স্থাপনাতে গুপ্ত, পাল ও সেন আমলের সময়কালীন ব্যবহৃত ইট ও চুন-সুড়কির ব্যবহার দেখা যায়। স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে জলদুর্গ, প্রাসাদ দুর্গের থেকে একটু আলাদা। এ ধরনের স্থাপনার চারপাশ বেষ্টিত থাকবে এবং নদী মুখী করে টাওয়ার থাকবে, সাধারনত টাওয়ারে বসানো থাকত কামান।
ইদ্রাকপুর জলদুর্গের প্রাচীরের অগ্রভাগ শাপলা ফুলের পাপড়ীর ন্যায় এবং দূর্গাভ্যন্তর থেকে শত্রুর প্রতি গোলা নিক্ষেপের জন্য অসংখ্য চতুষ্কোনাকৃতির ফোরক বিদ্যমান । দূর হতে শত্রুর গতিবিধি বোঝার জন্য প্রাচীরের পূর্ব দেয়ালের মাঝখানে ৩৩ মিটার উচু একটি মঞ্চ রয়েছে। দুর্গের দেয়াল গুলোর বর্তমান উচ্চতা ৪/৫ ফুট এবং পুরুত্ব ২-৩ ফুট। দুর্গের মূল ফটকটি দূর্গের ঠিক উত্তর দিকে।
কেল্লাটির ভূমিকম্প প্রতিরোধ ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রনে অভিনব এক পদ্ধতির ব্যবহার দেখা যায়, সারিবদ্ধ হাড়ি স্থাপন করে কুটিরের মেঝে তৈরী করা হয়েছিল যা পরবর্তীতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে উন্মোচন করা হয়।
লোকমুখে এখনও প্রচলিত আছে ইদ্রাকপুর দুর্গ থেকে লালবাগ দুর্গে যাওয়ার জন্য গুপ্তপথ ছিল, কিন্তু এমন কোন প্রমান পাওয়া যায় নি। সাধারনত জলদুর্গের অভ্যন্তরে সুড়ঙ্গের মতো স্থাপত্য রাখা হতো। এগুলো প্রথমত, গোলাবারুদ সংরক্ষনে ব্যবহৃত হত; দ্বিতীয়ত, সংকটের সময় দুর্গ হতে বেড়িয়ে আসার পথ হিসেবেও কাজে লাগত। দুর্গটিতে একটা গোপন কক্ষ পাওয়া যায়। অনুমান করা হয় এটি সম্ভবত ‘অস্ত্রের সংগ্রাহক গুদাম’ ছিল।
ইদ্রাকপুর দুর্গের নৌ বাহিনীর প্রধান ছিলেন আবুল হোসেন। তার নিয়ন্ত্রনে ২০০ টি নৌযান ছিল যা পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, ইছামতির তীরে সর্বদা প্রস্তুত থাকতো। অন্যদিকে পদাতিক বাহিনীর প্রধান ছিল সদলী খান। যিনি মগ রাজা মঙ্গত রায়কে দমন করেছিলেন।
নৌ প্রধান আবুল হোসেনের সময়ে ইদ্রাকপুর দুর্গ নিয়ন্ত্রনে ব্যবহৃত নৌযান গুলো হলো: কোষা, জলবা, গুরব, পারিন্দা, বজরা, তাহেলা, সলব, খাটগিরি, মালগিরি।
১৯০৯ সালে এ কেল্লাটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষনা করা হয়।
————————
লিখেছেন:
মো: শরীফ,
শিক্ষার্থী, ৪৯ তম আবর্তন
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সাভার, ঢাকা।